রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ অপরাহ্ন
অপরাধ দূর্গের সৌজন্যে: অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য অশনি সঙ্কেত। নিজের ও স্বজনদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে না চাইলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভালো। কারণ, ৫৭ ধারা বাতিল হলেও স্বাধীনভাবে সংবাদ প্রকাশ বা কথা বলার অধিকার নিশ্চিত হয়নি। বরং নতুন আইনের ৩২ নম্বর ধারায় যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে একে আরো ‘ভয়ঙ্কর’ বলে আখ্যায়িত করছেন বিশ্লেষকরা। এতে বাধাগ্রস্ত হবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। বিশেষ করে ৩২-এর মারপ্যাঁচে অনলাইন গণমাধ্যম ও বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকরা পড়বেন মহা বিপাকে। অন্যদের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ কমলেও সাংবাদিকদের জন্য কোনো আশার বাণীও নেই নতুন ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে। নতুন আইনের ৩২ বা ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে জামিন অযোগ্য হবেন। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা অ্যাক্টিভিস্ট তাদেরকেও আরো সতর্ক হতে হবে। এমপি-মন্ত্রী বা সরকারের কোনো পর্যায়ের ব্যক্তি অপমান বোধ করেন- এমন স্ট্যাটাস দিলেই যেতে হবে কারাগারে। হবে অর্থদ-ও। নতুন ডিজিটাল আইনের ধারা পর্যালোচনা ও বিশেষজ্ঞদের মতামতে এমনটাই উঠে এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, দুর্নীতিবাজ এমপি, মন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষা দিতেই এমন আইন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অবশ্য ‘এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বলে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তা স্বীকারও করে নিয়েছেন। যদিও আইনমন্ত্রী ভিন্ন কথা বলছেন।
সূত্র বলছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বহুল বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হয়েছে। যে ধারায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাংবাদিকরা। সেই সাথে মানবাধিকারকর্মী, মুক্তমনা- ব্লগার ও ক্ষমতাসীনদের বিরোধী রাজনীতিবিদ, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। এ ধারায় ইতিপূর্বে সাংবাদিকদের কারাগারে প্রেরণের একাধিক ঘটনা তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের তরফ থেকে ৫৭ ধারাকে ‘নিবর্তনমূলক’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানানো হয়। দিন দিন এ দাবি জোরদার হওয়ার পর অবশেষে তা বিলুপ্ত করা হয়। কিন্তু তার পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়।। গত সপ্তায় এই আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় অনুমোদনও দেয় মন্ত্রিসভা।
নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বনাম ৫৭ ধারা
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ (আইসিটি আইন)’ এর চূড়ান্ত খসড়া গত ২৯ জানুয়ারি অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হলেও এ ধারার অপরাধগুলো খসড়া আইনের চারটি ধারায় ভাগ করে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ফলে আইনটির অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। শুধু তাই নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথ আরও সংকুচিত হয়েছে। এমনকি ৫৭ ধারার চেয়েও নতুন ৩২ ধারাকে ‘ভয়ঙ্কর’, ‘নিকৃষ্ট’ ও ‘খারাপ’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় উল্লেখ ছিল, ‘(১) কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এ ধারায় অনধিক ১৪ বছর কারাদ- এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান ছিল।
নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকা-, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণœ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। খসড়া আইনে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। আইনের ২১ ধারার প্রস্তাব অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১৪ বছরের কারাদ- বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
খসড়াটি পর্যালোচনা করে আরও দেখা গেছে, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধগুলো নতুন আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় বিন্যস্ত করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদিত ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে সর্বনিম্ন সাত বছরের শাস্তির বিধান তুলে দেয়া হয়েছে এবং অপরাধের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ রয়েছে। আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজারও বিধান রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কেউ কোনো কিছু রেকর্ড করলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে। এর জন্য ১৪ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। খসড়া আইনের ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শনমূলক তথ্য প্রেরণ করেন, ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশ করেন, মিথ্যা জানা থাকার পর কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য তথ্য প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, তা হলে এটা অপরাধ হবে। প্রথম দফায় এ অপরাধের শাস্তি হবে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড প্রদান। এসব অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ২৮-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি বা মূল্যবোধে আঘাত করার জন্য ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ করে, তা হলে সাত বছরের কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড একসঙ্গে দেয়া হবে। ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইটে পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ বর্ণিত অপরাধ করেন, তা হলে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। পেনাল কোডের সেকশন ৪৯৯-এ মানহানির কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়, তা হলে তা অপরাধ হবে। এ অপরাধের জন্য সাত বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার বা বারবার এ অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অপরাধের গুরুত্ব ও দণ্ডের মাত্রার ভিত্তিতে খসড়া আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪Ñ এই ১৫টি ধারার অপরাধকে অজামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে, মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম জানান, আইসিটি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল করে এর পরিবর্তে এসব ধারায় অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হবে। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেকবার সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে বা আইসিটি বা অন্য আইনে যা নেই, সেটিই নতুন আইনে রাখা হয়েছে। ৫৭ ধারায় মামলা হলেই গ্রেফতার করার যে বিধান ছিল, এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এখন অপরাধ বিবেচনা করে কোনটি জামিনযোগ্য, কোনটি নয়, তা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, মন্ত্রিসভায় পাসের পর ধারাবাহিকতাক্রমে খসড়া আইনটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। সেখানে পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
আইনমন্ত্রীর ভাষ্য
এদিকে নতুন ডিজিটাল আইনের ভয়ঙ্কর দিকগুলো তুলে ধরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছেন, কেউ যেন অযথা হয়রানি না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই দাবি করেন আইনমন্ত্রী। তার ভাষ্য, ‘গুপ্তচর একটি অপরাধ। এর সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। নতুন আইনটি অপপ্রয়োগের সুযোগ ৯৭ শতাংশই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি কথা দিয়েছিলাম, ৫৭ ধারা থাকবে না। ৫৭ ধারা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, সে বিতর্কের অবসান ঘটল।’ যদিও গত ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক মিট দ্যা প্রেস’ অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবহার করা না যায় এজন্য প্রয়োজনবোধে প্রস্তাবিত আইনে সংশোধনী আনা হবে। কিন্তু মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরও আশ্বস্ত হতে পারছেন না সাংবাদিকরা। যতক্ষণে না আইনটির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলোর ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্ট না হবে ততক্ষণ এই আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাবে।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে ৫৭ ধারার চেয়েও নিকৃষ্ট নতুন আইন
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এর ৩২ ধারা নিয়ে ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘কারো বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলেই এই আইন প্রয়োগ করা হবে। জিম্বাবুয়ে ও উত্তর কোরিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশে এমন আইন নেই। ৫৭ ধারাতে যেসব শাস্তির বিধান করা হয়েছিল তাও ডিজিটাল সিকিউরিটিতে রয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তৈরি ৩২ ধারা। ৩২ ধারার মানে হচ্ছে, দুর্নীতি, অনিয়ম ও অবিচারের বিরুদ্ধে কোনো সূত্রের মাধ্যমে কোনো রিপোর্ট দিতে পারবেন না। যদি এটার অনুমোদন না থাকে। ৩২ ধারা বলছে, কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে বা কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে গিয়ে বলতে হবে যে ভাই আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ আছে তার একটি নথিপত্র দেন। তিনি কি বলবেন যে তথ্যগুলো দিলাম আপনি প্রচার করেন? এটি কখনও হবে না।’ আসিফ নজরুলের মতে, ‘সাংবাদিকতার সূত্রই হচ্ছে গোপন রাখা। তবে একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, আপনি যে জিনিসটি প্রকাশ করছেন তা সত্য কিনা। একটি দেশ ও সরকার শুধু এই জিনিসটি দেখতে পারে। কিন্তু আপনি কোনো জিনিস কোনো সূত্রে পেলেও সরকারের অনুমতি ছাড়া, কোনো নথি ছাড়া আপনি নিতে পারবেন না। আমাদের সাবকন্টিনেন্টে এই ধরনের জঘন্য আইন নেই। এটি ৫৭ ধারা থেকেও নিকৃষ্ট আইন। ৩২ ধারা একটি নতুন এলিম্যান্ট যোগ করেছে। এখন শাস্তি ১০ বছর থেকে ৭ বছর করেছে কিনা, কিছু কিছু অপরাধ জামিন যোগ্য করা হয়েছে কিনা। এটি খুবই ছোট খাট একটি দিক।’
আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একমত নন মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকারকর্মী নূর খানও। এক প্রতিক্রিয়ায় নূর খান বলেন, নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আগের ৫৭ ধারাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওই আইন বাতিল করে এবার যা করা হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে এবং সাংবাদিকদের তথ্যসংগ্রহ আরো কঠিন হয়ে পড়বে। নতুন খসড়া আইন প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ৫৭ ধারা যেভাবে ছিল, নতুন এই আইনটিতে তা-ই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিধি-বিধানগুলো আগে যেভাবে ছিল, তার চেয়ে বরং কঠিন। কঠিন বিধি-বিধান যুক্ত হয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে শাস্তির পরিমাণ কমেছে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বেড়েছে। কী কী কারণে শাস্তি হতে পারে বা কী কী কারণে মামলা হতে পারে, এর পরিসর বেড়েছে। এতে মানুষের উপকার তো হবেই না, বরং মতপ্রকাশের পথ আরও সংকুচিত হবে।
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮কে নিবর্তনমূলক আইন হিসাবে উল্লেখ করে বিএনপি নেতারা বলেছেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা রেখে দেয়া হয়েছে। শুধু নামটা পরিবর্তন করা হয়েছে। কার্যত আইসিটি আইনের বিধান ঘুরেফিরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্থান পেয়েছে। এটা দিয়ে সরকার ধোঁকাবাজি করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আইসিটি আইনের চেয়েও খারাপ। কিছু ক্ষেত্রে আইনটি আরও কঠিন করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ (আইসিটি আইন)’ এর খসড়া মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর বিএনপি নেতারা প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই নিবর্তনমূলক আইন নিয়ে ইতোমধ্যে সবাই বলতে শুরু করেছেন। কেবল খোলসটা পরিবর্তন করা হয়েছে, মূল আইনটা থেকেই গেছে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার আর কিছু বাকি নেই। দেশ একদলীয় শাসনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
বিশেষজ্ঞদের ধারণার সত্যয়ন করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। সংসদ সদস্যদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রভাবশালী এই মন্ত্রী। ৩০ জানুয়ারি নিজ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা (সাংবাদিকরা) গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাদের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘গণমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতে এ আইন করা হলেও আমার বিশ্বাস আপনাদের (সাংবাদিক) ঠেকানো যাবে না।’
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২২ জুলাই বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়। নানা বিতর্কের পর ওই আইনের ৫৭ ধারা বিলুপ্ত হলেও আইনটির অপপ্রয়োগের সুযোগ থেকেই গেল।